একটু অস্থির, ছটফটে স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তার আজব কাণ্ড-কারখানার গল্প আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। এক নিমেষে হাসিয়ে ছাড়তেন সকলকে। আর রেগে গেল… । ১৯২৯ সালে জন্ম ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তী শিল্পী কিশোর কুমারের। নাচ, গান, অভিনয়– সব দিকেই সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী ভারতীয় সিনেমায় বিরল।
কিশোর কুমার ভারতীয় সিনেমার উজ্বলতম নক্ষত্র। নাচ,গান, অভিনয় সব দিকেই সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী ভারতীয় সিনেমায় বিরল। কিশোর কুমার এমন একজন শিল্পী যিনি পর পর আটবার ফিল্মফেয়ার আ্যওর্য়াড পান। যা এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি।
কিশোর কুমারের জন্ম ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায়। বাবা কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন আইনজীবী। চার ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন কিশোর কুমার। অশোক কুমার সবার বড় তারপর দিদি সতী দেবী তারপর অনুপ কুমার ও সর্বকনিষ্ঠ কিশোর কুমার। তাঁর আসল নাম ছিল আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়।
কিশোর কুমার বলিউডে তাঁর কেরিয়ার শুরু করেন ‘বম্বে টকিজে’ কোরাস সিঙ্গার হিসেবে। সেই সময় বলিউড ইন্ডাস্ট্রির বড় স্টার অশোক কুমার। তাঁর ইচ্ছে ছিল ভাই তাঁর মতো অভিনেতাই হন। কিন্তু কিশোরের মন পড়েছিল গানের দিকেই।
কিশোর কুমারের অভিনেতা হিসেবে বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ হয় ‘Shikari’(১৯৪৬) ছবিতে। এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন অশোক কুমার। প্রসঙ্গত,১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ এর মধ্যে ২২টি ছবিতে কাজ করেন কিশোর কুমার। তাঁর মধ্যে ১৬টি ফ্লপ ছবি। তারপর ‘লড়কি’ ও ‘বাপ রে বাপ ‘ছবিতে সাফল্য পাওয়ার পর অভিনেতা হিসেবে তাঁকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন পরিচালক প্রযোজকরা।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর অনুগামীরা। তাঁর ভক্তের সংখ্যা অগুণতি। তবে কিশোর কুমার নিজে ছিলেন হলিউডের সংগীত শিল্পী Danny Kaye-এর ভক্ত। ‘Roop tera mastana’ গানের জন্য ১৯৭০ সালে প্রথম ফিল্মফেয়ার আ্যওর্য়াড পান কিশোর কুমার। প্রথমবার ভারতীয় গানে ইউডলিং-এর ব্যবহার কিশোর কুমার করেন। তবে তাঁর গানের মধ্যে ইওডেলিং স্টাইল বিখ্যাত সংগীত শিল্পী Jimmie Rodgers এবং Tex Morton এর স্টাইল থেকে অনুপ্রাণিত।
বরেণ্য সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মনের কথাতেই এই ইওডেলিং স্টাইলটি রপ্ত করেন কিশোর কুমার।
কিশোর কুমার সবথেকে বেশী গলা দিয়েছেন রাজেশ খান্নার জন্য প্রায় ২৪৫ টি গান গেয়েছেন তাঁর লিপে। তারপরই রয়েছেন দেব আনন্দ, জিতেন্দ্র ও অমিতাভ বচ্চন। পরে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে মন কষাকষি হয় কিশোর কুমারে একটি সিনেমাকে কেন্দ্র করে। তাঁর গাওয়া ‘Aake seedhi lagi dil pe’ গানটির কথা সবার জানা। এই গানটিটে ছেলে ও মেয়ের গলায় গেয়েছেন কিশোর কুমার। তবে মেয়ের অংশটি গাওয়ার কথা ছিল লতা মঙ্গেশকরের।
লতা দেশের বাইরে থাকাতে সুরকার সলিল চৌধুরীকে গানের দুটো ভার্সনই নিজে গাইতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
বাকিটা ইতিহাস।
সরকারের রোষানলে পড়ে একবছরের জন্য ভারতীয় রেডিও ও দূরদর্শন ব্যান করেছিল কিশোর কুমারকে। কারণ ১৯৭৫ এ জরুরি অবস্থার সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় বিনে পয়সায় গাইতে বলা হয়েছিল তাঁকে। সেই প্রস্তাব নাকচ করেন কিশোর কুমার। তারপরই ব্যান করা হয় তাঁকে।
তিনি তাঁর জীবনে চারবার বিয়ে করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতা। আট বছরের দাম্পত্য জীবন তাঁদের। দ্বিতীয় স্ত্রী মধুবালা, তার সঙ্গে নয় বছর ঘর করেন।
মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য মুসলিম হন কিশোর কুমার নাম নেন করিম আবদুল। তৃতীয়বার বিয়ে করেন যোগিতা বালিকে। যিনি বর্তমানে মিঠুন চক্রবর্তীর স্ত্রী। তবে যোগিতা ও কিশোরের বিবাহিত জীবন টিকে ছিল মোটে দু-বছরের জন্যে( ১৯৭৬-১৯৭৮)। চতুর্থবার বিয়ে করেন লীনা চন্দ্রভারকরকে। আমৃত্যু তাঁর সঙ্গেই ছিলেন কিশোর কুমার। শোনা যায় যোগিতা বালি তাঁকে ছেড়ে মিঠুন চক্রবর্তীকে বিয়ে করায় গান বন্ধ করে দেন এই কিংবদন্তী শিল্পী। তাঁর চারটি বিয়ে থেকে দুটি সন্তান রয়েছে অমিত কুমার ও সুমিত কুমার। দু’জনেই সংগীত শিল্পী।
রাজেশ খান্না ও অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘আনন্দ’ ছবিটি প্রথমে করার কথা ছিল কিশোর কুমার ও মেহমুদের। কিন্তু এই ছবির পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় যখন ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে কথা বলতে যান তাঁকে পূর্বের টাকা পয়সা সংক্রান্ত বিবাদের কারণে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন কিশোর। শেষ জীবনে একেবারে একাকীত্বে দিন কাটিয়েছেন তিনি, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজের একাকীত্বের কথা বলেছেন তিনি। কিশোর কুমার ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ীর মামা। ১৯৮৭ সালে ১৩ অক্টোবর মুম্বইতে মারা যান এই কিংবদন্তী শিল্পী।