
| রবিবার, ১০ আগস্ট ২০২৫ | প্রিন্ট | 329 বার পঠিত
একবছর-দুইবছর নয়! গুনে গুনে ৪৮টি বছর পার করেছেন শিক্ষকতা করে। অনেকেই তার কাছে প্রাইভেট পড়ে পৌঁছেছেন উচ্চতার শিখরে। মাস শেষে অনেক শিক্ষার্থী টাকা দিয়েছেন আবার কেউবা দিতে পারেনি। কিছুই বলেননি তিনি। রোজ ভোরে ভাঙাচোরা একটি সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন, ফিরতেন গভীর রাতে। কিন্তু আজ তিনি ভাগ্যের কাছে অসহায়। বলছি গয়নাথ সরকারের কথা।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের কুমারগাড়া গ্রামের এই প্রবীণ শিক্ষক হারিয়েছেন শিক্ষকতা! একসময় যার হাতে ও পেেকট কলম থাকতো সেই মানুষটি এখন রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণ এবং পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া এই মানুষটি কোনো কাজ না পেয়ে এখন করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি!
শনিবার সকালে পৌর শহরের সাহাপাড়া মহল্লায় একটি বাড়িতে বস্তায় করে বালু টানার সময় কথা হয় এই শিক্ষকের সাথে। তিনি জানান, ১৯৮৪ সালে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করেন গয়ানাথ সরকার। কিন্তু পরিবারের দরিদ্রতার কারণে পড়ালেখার পাঠ চুকে যায় তার। শুরু করেন প্রাইভেট পড়ানো। পাশাপাশি দিনমজুরির কাজ করে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। ছোট বেলা থেকেই ইংরেজি ও অংকে পারদর্শী গয়ানাথ পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করেন।
দিনরাত ব্যাচ আকারে প্রাইভেট পড়াতে থাকেন গয়ানাথ সরকার। অল্প সময়ের মধ্যেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গয়নাথের শিক্ষকতার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। বাড়ি বাড়ি পড়ানো শুরু করেন। এরপার পৌর শহরের মধ্যে একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে চাকরি পেয়ে যান। অল্প বেতন হলেও শুধুমাত্র সম্মানের আশায় এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন দিনের পর দিন। কিছুটা স্বচ্ছলতা এলে বিয়ে করেন গয়নানাথ সরকার। এরপর একে একে তিন সন্তানের জন্ম দেন এই স্কুল শিক্ষক।
দরিদ্রতার কারনে নিজের পড়ালেখা হয়নি বলে তিন সন্তানকে মানুষ করার ব্রত নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন এই মানুষটি। বড় ছেলে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে, দ্বিতীয় ছেলে দশম শ্রেণিতে এবং একমাত্র মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। প্রাইভেট পড়িয়ে এবং বে-সরকারি ওই কেজি স্কুলে চাকরি করে যে টাকা আয় করতেন তাতে করে ভালোই চলছিল গয়নাথ সরকারের। বছরখানেক আগে বেতন বাড়াতে বলায় স্কুল থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেন গয়নাথ সরকার। এরপর প্রাইভেট পড়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু এবার গয়নাথের ভাগ্যে নেমে আসে অন্ধকার।
পৌর শহরের বিভিন্ন স্কুলের যেসব ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতেন গয়নাথ সরকার, সেইসব স্কুল থেকে অভিভাবকদের বলা হয়, ‘স্কুলের শিক্ষকদের কাছে না পড়ালে নম্বর কম পেলে এই জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।’ এরপর থেকেই একে একে কমতে তাকে গয়নাথের শিক্ষার্থীর সংখ্যা। একটা সময় পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন প্রবীণ এই শিক্ষক। জেঁকে বসে দরিদ্রতা।
একদিকে সংসার চালানো, অন্যদিকে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া গয়নাথ বেছে নেন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ। দিনশেষে হাজিরা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মতো। গয়ানাথের মেধা ও কলমের ছোঁয়ায় কেউ হয়েছেন ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার আবার কেউ বা হয়েছেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ। কিন্তু কেউ খোঁজ রাখেন না তাদের প্রিয় স্যারের! যে মানুষটি একসময় মেধা ও কলমের ছোঁয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের ভিত গড়ে দিতেন সেই মানুষটি এখন মানুষের বসবাসের ভিত গড়ার কাজ করে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। লজ্জা পেলেও জীবনের প্রয়োজনে চাটমোহরের এই প্রবীণ শিক্ষক এখন হয়েছেন রাজমিস্ত্রির জোগালি।
ইব্রাহিম হোসেন মোল্লা নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই অংকে দূর্বল ছিল। অনেক দূর থেকে প্রতিদিন গয়ানাথ স্যারের কাছে নিয়ে আসতাম। এখন আমার ছেলে কলেজে পড়ে। শুধু তাই নয়, অংকটাও এখন ভালো পারে। কিন্তু অবাক হচ্ছি দ্যুতি ছড়ানো একজন শিক্ষককে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতে দেখে!’
কান্নাজড়িত কন্ঠে গয়ানাথ সরকার বলেন, ‘শিক্ষাকালীন অবস্থাতেই আমি প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষকতা করে এসেছি। কিন্তু হটাৎ করেই শিক্ষকতা পেশা থেকে ছিটকে যাব ভাবতে পারিনি। চেয়েছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সম্মানের সাথে বাঁচতে। কিন্তু আজ আমি নিরুপায় হয়ে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করছি। এতে আমার খুব কষ্ট হলেও এটাই আমার নিয়তি!
Posted ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১০ আগস্ট ২০২৫
manchitronews.com | Staff Reporter