সাইফুর রহমান তপন | বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪ | প্রিন্ট | 171 বার পঠিত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন নেতার বুধবার সকালের বৈঠকটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। প্রথমত, বৈঠকটি ছিল অনির্ধারিত। দ্বিতীয়ত, এর আগে বিএনপি নেতারা যতবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন; অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলটির পক্ষ থেকেই আগ্রহ ব্যক্ত করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়; ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণের পর থেকে বিএনপি মহাসচিবসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বলতে শোনা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কার মূলত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই করবেন। তাই সংস্কার ও নির্বাচনের আয়োজন পাশাপাশি চলতে পারে। কিন্তু সরকারের অবস্থান তা থেকে স্পষ্টতই ভিন্ন ছিল। প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরই নির্বাচন– এমন মতই তারা ব্যক্ত করে এসেছে। অর্থাৎ এতদিন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বা সরকার সমর্থক ছাত্রনেতাদের বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছিল, তারা বিএনপির উদ্বেগগুলো খুব একটা আমলে নিতে রাজি নন। সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সেখানেও এই মনোভাব স্পষ্ট। কিন্তু বুধবারের বৈঠক যেন সরকারের এ বিষয়ক অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী।
এটা স্পষ্ট, বুধবারের বৈঠকটির মূল এজেন্ডা ছিল রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ ইস্যু ঘিরে। তাঁর পদত্যাগ দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; প্রধান উপদেষ্টা যাদের প্রায়ই তাদের নিয়োগকর্তা বলে থাকেন– মঙ্গলবার দিন থেকে গভীর রাত অবধি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছে। সেখানে এ সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করা হয়।
রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিষয়ে স্ববিরোধী মন্তব্য করেছেন। ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর ভাষণে রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন বলে দাবি করলেও, সম্প্রতি একটি দৈনিকের সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কথা আর সবার মতো তিনিও শুনেছেন মাত্র। এ-সংক্রান্ত কোনো নথি তাঁর কাছে নেই।
সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পরপরই সরকারের আইন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে জাতির সঙ্গে ‘মিথ্যাচার’ এবং ‘শপথ ভঙ্গের’ অভিযোগ আনেন। তিনি এমনও বলেন, এসব কারণে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আলোচিত হতে পারে। এর পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংও ওই মন্তব্য সমর্থন করেন। এ প্রেক্ষাপটেই মঙ্গলবার ছাত্রদের বিক্ষোভটি অনুষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে তারা আলটিমেটাম দেয়। এমনকি এসবের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমনও প্রতিবেদন লেখা হয়- রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ক্ষেত্র প্রস্তুত।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বুধবার বিএনপির বৈঠকের পর মনে হচ্ছে, হাওয়া ভিন্নদিকে বইছে। বৈঠক-পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, দেশে যাতে ‘নতুন করে সাংবিধানিক সংকট’ না সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে তারা সরকারকে সতর্ক করেছেন। তাঁকে সাংবাদিকরা সরাসরি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। তবে ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ– সমকাল অনলাইনে যেমনটা বলা হয়েছে, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সরাসরিই বলেন, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হবে। তাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় না বিএনপি।
এখানেই শেষ নয়। বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের ব্রিফিংয়েও– ডেইলি স্টার লিখেছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ-সংক্রান্ত ছাত্রদের আলটিমেটাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যারা এই আলটিমেটাম দিচ্ছে, তাদের এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন।’ কথাটা একটু কড়াই বটে। বিক্ষোভকারীদের বঙ্গভবনের আশপাশে না থাকার জন্য বলা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
সরকারে শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রতিনিধি ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও বুধবার বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি থাকবেন কি থাকবেন না– এই প্রশ্নটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আইনি বা সাংবিধানিক কোনো প্রশ্ন নয়। এটি একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতা এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।’ (ডেইলি স্টার বাংলা) এখানে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ কথাটা বেশ প্রণিধানযোগ্য।
আমার মতো আরও অনেকেই মনে করবেন, দেশে আপাতত কোনো সাংবিধানিক সংকট নেই। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বরং সেই সংকট তৈরি করতে পারে। বিএনপিও এ বার্তাটিই স্পষ্ট করেছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ছাড়াও ছাত্ররা আরও কিছু দাবি জানিয়েছে। যেখানে আছে– অবিলম্বে সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন। সত্য বলতে, একই বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই আমরা শুনে আসছি। কিন্তু বুধবার নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, তারা সরকারকে আরও যা পরামর্শ দিয়েছেন তা হলো, ‘সংস্কার দ্রুত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে করা; জনগণের চলমান সংকটের দ্রুত সমাধান করা এবং এই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’ (ডেইলি স্টার বাংলা)।
বর্তমান সময়ে যে অন্তত ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব নয়– তা সচেতন মহল সম্ভবত স্বীকার করবে। বিশেষত যখন বিএনপি স্পষ্ট করেই বর্তমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জনপ্রিয় দাবির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে।
বিএনপি বরং ‘দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনগণ যে কষ্ট পাচ্ছে, সেটা লাঘবে সরকারকে আরও তৎপর ও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান’ জানিয়েছে। (ডেইলি স্টার বাংলা) আসলেই সরকারের এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
গণঅভ্যুত্থান এখানে এর আগে অন্তত দু’বার হয়েছে– ১৯৬৯ ও ১৯৯০ সালে; কোনোবারই অন্তত রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘ অপেক্ষায় রেখে সংস্কার বা অন্য কিছু হয়নি। ১৯৬৯ সালে তো সামরিক শাসক আইয়ুব খানের জায়গায় আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরেরও কম সময়ে নির্বাচন দেন। আর ১৯৯০ সালে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রিয় দল হিসেবে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ওই দুই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য এই নয় যে, সংস্কারের জন্য ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো বসে থাকবে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারও জনপ্রিয়তা নিয়েই রাষ্ট্র সংস্কারে হাত দিয়েছিল। কিন্তু তার ফল শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা আমরা দেখেছি।
রাষ্ট্র সংস্কার একটি নিরেট রাজনৈতিক বিষয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপরই তার জন্য নির্ভর করতে হবে। বর্তমান সরকার বড়জোর কিছু সুপারিশ তৈরি করতে পারে, যা আগামী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে। নাগরিকদের মধ্যে যদি সত্যিই সংস্কারের ক্ষুধা থাকে তাহলে সেই নির্বাচিত সরকার সংস্কার কার্যক্রম এড়াতে পারবে না। কিন্তু তার জন্য সময়ক্ষেপণ বরং নানা জটিলতা বাড়াবে।
আমার ধারণা, শুধু বিএনপি নয়; বামপন্থি দলগুলোও সময়ক্ষেপণের বিপদ আঁচ করছে। তাই তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে ‘দ্রুত’ নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করেছে। অবশ্য দ্রুত নির্বাচন আয়োজনই তাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত– সরকারও সম্ভবত তা বোঝে। তারা ইতোমধ্যে এমনকি বিগত সরকারের তৈরি বহুল সমালোচিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের অধীনেই সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে চলেছে।
সব মিলিয়ে বলাই যায়, শুভস্য শীঘ্রম।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
Posted ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
manchitronews.com | Staff Reporter