মঙ্গলবার ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকার সকাল শুরু বিষাক্ত বাতাসে

  |   সোমবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   92 বার পঠিত

ঢাকার সকাল শুরু বিষাক্ত বাতাসে

সংগৃহীত ছবি

শুক্রবার ছুটির সকাল। ভোর ৫টা। তখনও ঢাকার রাস্তা একদম ফাঁকা। নেই যান চলাচল। ঠিক সেই মুহূর্তেও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) বা বায়ুর মান সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার অবস্থান দেখা গেল শীর্ষে। আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে তখন ঢাকার স্কোর ছিল ২১১, যা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। বাতাসে এমন বিষ ছিল সকাল ১১টা পর্যন্ত।

পরদিন শনিবার শুভ মহালয়ার কারণে ছিল সরকারি ছুটি। এদিন সকাল ৮টায় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ওয়বেসাইটে দেখা গেল, যথারীতি শীর্ষ অবস্থানে ঢাকা। বাতাসের মানসূচকে ঢাকার অবস্থান ছিল ২১৯। গতকাল রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দূষণে শীর্ষস্থান ধরে রাখে ঢাকা। এভাবে নিঃশ্বাসে বিষাক্ত বাতাস নিয়েই দিন শুরু করে এ নগরের মানুষ। গত ১৫ দিনের মধ্যে ১১ দিনই ঢাকার সকাল ছিল দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে।

প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর নিস্তব্ধ ভোরেও কেন এতটা বিষাক্ত? যান চলাচল নগণ্য, দোকানপাট বন্ধ, নেই মানুষের আনাগোনা– তবুও কেন বিষ ছড়াচ্ছে সাতসকালেই? তার কারণ জানতে শহরের বেশ কিছু সড়ক ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। গতকাল ভোর ৪টা। রাজধানীর আসাদগেট থেকে গাবতলী সড়কে নেই তেমন যাত্রীবাহী বাস কিংবা প্রাইভেটকার। তবে বীর দর্পে একের পর এক ছুটছে ট্রাক। এর মধ্যে বেশ কিছু ট্রাক বালুবোঝাই, ওপরে নেই কোনো ঢাকনা। তীব্র গতিতে চলা ট্রাক থেকে বাতাসে উড়ছে বালু। মোহাম্মদপুর থেকে বছিলার পথেও দেখা গেল বেশ কিছু মাটিবোঝাই ট্রাক।

এগুলো যে পথ দিয়ে যাচ্ছে, সেখানেই পড়ছে মাটি। আরও অন্তত তিনটি সড়ক ঘুরে দেখা গেল সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী বেশ কিছু ট্রাক। একটি ট্রাকেও নেই কোনো ঢাকনা। রাস্তায় রাস্তায় ছড়াচ্ছে দূষণ। রাজধানীর ধানমন্ডি, পান্থপথ ও মোহাম্মদপুরে ভোর ৫টার দিকে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়কে ঝাড়ু দিচ্ছে। এ সময় চারপাশে উড়ছে ধুলা।সকাল কিংবা ভোরে ঢাকার বাতাস কেন এত বিষাক্ত– এই প্রশ্ন করেছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেককে। তিনি জানান, ঢাকায় অফিস ছুটির পর সন্ধ্যা থেকেই গাড়ির ধোঁয়ায় দূষণ বাড়তে থাকে। ভোরে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়কে ঝাড়ু দেন। এ সময় পুরো শহরে ধুলা ওড়ে।

রাত ১০টার পর নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় নিয়ে ট্রাক চলাচল করে। রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে গাড়িগুলো চলায় সড়ক বিভাজকের পাশে জমে থাকা ধুলা চাকার সঙ্গে উড়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ইটভাটাও দিনের তুলনায় রাতে বেশি চলে। ফলে রাতের শহরে দূষণের মাত্রা বেশি হয়। আর সে ধুলা কখনও কখনও দুপুর ১২টা পর্যন্ত উড়তে থাকে। ফলে ঢাকার সকাল দূষণ দিয়েই শুরু হয়।রাতে ঢাকাসহ চারপাশের এলাকায় পলিথিনসহ প্লাস্টিক পোড়ানো হয় জানিয়ে এই পরিবেশ বিজ্ঞানী বলেন, আমিনবাজার ও হেমায়েতপুরের মাঝখানে যে ময়লার ভাগাড় আছে, তার আশপাশে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত যাওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে যখন ভাগাড়ে ময়লা ও প্লাস্টিক পোড়ানো হয়, তখন দম বন্ধ হয়ে আসে। এই দূষণ সকালে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার মানুষের দেহে প্রভাব ফেলছে।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) বলছে, ঢাকায় ৬০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় রাত কিংবা সকালবেলায়। ক্যাপসের পরিচালক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, রাতে বায়ুর চাপ বেড়ে যায়। ওপর থেকে বায়ু নিচের দিকে চাপ দেয়। রাতে তাপমাত্রা কমে যায় এবং কুয়াশা পড়ে, এ কারণে আকাশ ভেজা ভেজা থাকে। আবার দেখা যায় দিনের বেলায় বায়ুপ্রবাহের গতি বেশি থাকে, রাতে কম থাকে। এসব কারণে ধুলাবালি নিচের দিকে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের গত বছরের জুলাইয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মধ্যে রাস্তার ও মাটির ধুলা সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৪৩ শতাংশ)। এর পর পরিবহনের ধোঁয়া সাড়ে ৩৬ শতাংশ। পিএম ১০-এ ধুলার ভূমিকা ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ, গাড়ির ধোঁয়া প্রায় ৩৬ শতাংশ, জীবাশ্ম জ্বালানি ১৫ শতাংশ ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া সাড়ে ৬ শতাংশ।

এত দিন শীতকালে বায়ুদূষণ ভাবনার বিষয় ছিল। এখন বর্ষাকালেও দূষণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বায়ুদূষণ বেশি থাকে। এর পর তা কমতে শুরু করে। ক্যাপসের তথ্য মতে, গত আট বছরের জানুয়ারি মাসে বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল। এর গড় স্কোর ছিল ২৪৮। দূষণের দিক থেকে এর পর আছে ফেব্রুয়ারি, ডিসেম্বর, মার্চ, নভেম্বর, এপ্রিল, অক্টোবর, মে, জুন, সেপ্টেম্বর, আগস্ট ও জুলাই। গত ২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে বায়ুদূষণ নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেখানে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে বলা হয়। কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। সকালে আর বিকেলে একবার করে পানি ছিটিয়েই ক্ষান্ত দেওয়া হয়। তবে পানি ছিটানো হয় এমন ১২ স্থানে জরিপ চালিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপস দেখেছে, পানি ছিটানোর পরপর দূষণ কিছুটা কমে।

কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আবার তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধের বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। আর যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। দূষণ রোধে মাঝে মাঝে কিছু অভিযান ও সভা-সেমিনার করেইদায় শেষ করে তারা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, বায়ুদূষণ রোধে আমরা বসে নেই। নিয়মিত অভিযান চলছে। সমাজের সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব সচেতনভাবে পালন করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আসবে।

Facebook Comments Box

Posted ৭:২২ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৩

manchitronews.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক
এ এইচ রাসেল
Contact

5095 Buford Hwy. Atlatna Ga 30340

17709121772

deshtravels7@gmail.com

error: Content is protected !!