রবিবার ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডিম ও পোলট্রির বাজারে মূল্যবৃদ্ধির জন্য কারা দায়ী?

ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক   |   সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   397 বার পঠিত

ডিম ও পোলট্রির বাজারে মূল্যবৃদ্ধির জন্য কারা দায়ী?

সংগৃহীত ছবি

এর প্রধান হোতা কে বা কোন গ্রুপ সে তথ্য কিন্তু আমরা অনেক আগেই জেনেছি। ফেসবুকে এ নিয়ে অনেক পোস্ট দেয়া হয়েছে। সেই সুবাদের ডিম-মুরগির সিন্ডিকেট হচ্ছে কাজী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে এই গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তেজগাঁর ডিমের আড়তদারগণ যারা নিজেদের মতো করে প্রতিদিন দাম নির্ধারণ করেন। মাঠপর্য়ায়ের নিয়ন্ত্রক তারা। কিন্তু আসল কাজটি শুরু হয় গ্রুপের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে।

গ্রপের সিন্ডিকেটওয়ালারা যদি আজ মনে করেন যে আগামি কাল ডিম-মুরগির দাম আরো সামান্য বাড়িয়ে দেবেন ( সেটা ১০/১৫/২০ কিংবা ৫০ পয়সা কিংবা ১ টাকা হতে পারে) তাহলে সেই নির্দেশ আড়তদারদের কাছে চলে যায়। বন্যা, বানভাসি,ডিমের উৎপাদন ঘাটতি, মুরগি খামারিদের খাদ্য, পানি ও রোগপ্রতিরোধের অষুধের সংকট ইত্যাদি- (গ্রুপের মালিকরা কিন্তু ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন ও বিক্রির হোতা, পোলট্রি খাদ্যের উৎপাদকও তারাই) সংকটকে সামনে রেখে দাম বাড়িয়ে দেন। আর তার খেসারত যায় ভোক্তার ওপর।

ভোক্ত কারা? ভোক্ত হচ্ছে যাদের রসনায় ডিম খাওয়ার প্রয়োজন ও মুরগির মাংসের প্রতি দরদ, তাদের পকেট শূন্য হতে থাকে। বাজারে এ-দুটি নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারা সেই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। বিপিএ বলছে- `একইসঙ্গে ২০ দিনে অযৌক্তিকভাবে ডিম ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে অসাধু চক্র ২৮০ কোটি টাকা লুটপাট করেছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। শনিবার সংগঠনটির সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এসব অভিযোগ করেছেন।

তিনি বলেন, সারা দেশে ডিমের বাজারে অস্থিরতা চলছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ডিম-মুরগির দামও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কোনো প্রান্তিক খামারিকে ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণের ওয়ার্কিং গ্রুপ কমিটিতে রাখেনি। তারা শুধু করপোরেট গ্রুপদের পরামর্শে দাম নির্ধারণ করেছে। যার ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আবার এর জন্য ফিড ও মুরগির বাচ্চার উৎপাদনকারী কোম্পানি, তাদের অ্যাসোসিয়েশন এবং তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতিসহ অনেক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে।

আমরা এবার পুরোপুরিভাবে বুঝলাম কেবল করেপোরেট সিন্ডিকেটই নয়, কেবল আড়তদাররাই নয় দাম নির্ধারণে সরকারি কৃষি বিপণন অধিদফতরও জড়িত। তারা ডিম মুরগির দাম নির্ধারণের ওয়ার্কি গ্রুপে প্রান্কি খামারিকে রাখেনি। প্রান্কি খামারিদের রাখা হলে তাদের সমস্যা-সংকট উপস্থাপণ করতে পারতো এবং ১০.২৯ পয়সার উৎপাদন খরচের ডিমের দাম ১৩ টাকা নির্ধারণ করতে দিতো না। তারা ১২ টাকায়ই ভোক্তা পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করতে বলতো বা চাপ প্রয়োগ করতো।

একে আমরা বলতে পারি গ্যারান্ট্রি ক্লজ। অর্থাৎ প্রান্তিক খামারিরা সিন্ডিকেটওয়ালাদের এই মুনাফা লোটার সুযোগটা দিতো না। তারা জানে ওই বাড়তি দাম তারা পারে না। তারা বিশাল সিন্ডিকেট গ্রুপের নির্ধারিত দামেই ডিম-মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হতো। তাই তারা সরকারের বেঁধে দেয়া দামেরও বিরোধিতা করতো। এবং গণমাধ্যমকেও জানিয়ে দিতে পারতো। এতে করে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মুনাফার লোভ ও লুটেরা মানসিকতা জনগণ সরাসরি জানতে ও বুঝতে পারতো।

এবার একটি কল্পিত স্বপ্নের কথা বলি।
ঢাকা মহানগরের মানুষেরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে একদিন বা এক সপ্তাহ ডিম কেনা বন্ধ রাখে (তাতে তাদের পুষ্টির অভাব হবে, ঘাটতি হবে না।) তাহলে সিন্ডিকেওয়ালাদের কেবল ওই ২৮০ কোটি টাকাই কেবল লস হবে না, তাদের লসের পরিমাণ হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু এটা করবে না আমাদের গরিবি মানসিকতার জন্য। এই শ্রেণির গরিব মানুষেরই সকাল হলেই নাস্তার টেবিলে ডিম ছাড়া চলে না। তারা মনে করেন একমাত্র ডিমের পুষ্টি তারা পান সস্তায়।

মাছ-মাংস তারা সপ্তাহে একদিন কিনতে পারে কিনা সন্দেহ। আবার আজকাল শাক-সবজি কিনবেন, তারও কোনো উপায় নেই। দাম আকাশ ছোঁয়া। বানের কারণে উৎপন্ন শাক-সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে চাহিদা মতো ওই নিত্যপণ্য পাওয়া গেলেও চতুর বাজার ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েই বিক্রি করছেন। গতকাল ( ১০/০৭/২৪ ) সন্ধ্যায় খিলগাঁ রেল গেট পার হয়ে বনশ্রীর দিকে আসতে আসতে কাচামরিচের দাম জিজ্ঞেস করেছি। বললো ৪০০ টাকা কেজি। ধনে পাতা ১শ গ্রমের দাম চাইলো ৭০ টাকা। সাহস হারিয়ে আর কোনো সবজির দাম জিজ্ঞেস করিনি। আমাদের গরিবি চেতনায় ডিম ছাড়া চলেই না। এই সংস্কৃতি বাদ দিয়ে চলতে হবে। শায়েস্তা করতে হলে ডিমের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে। মাত্র এক সপ্তাহ বা একমাস ডিম কেনা বন্ধ করুন, দেখবেন, পরিস্থিতি কেমন হয়! আপনাদের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হবে, নিশ্চিত থাকেন।

বিপিএ নেতা বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ২৯ পয়সা। সে অনুযায়ী ১২ থেকে সাড়ে ১২ টাকা যদি ভোক্তা পর্যায়ের দাম বেধে দেয়া হয় বা দাম নিয়ন্ত্রিত থাকে তবে সেটি যৌক্তিক। কিন্তু সেই ডিমের দাম পৌঁছেছে ১৫ টাকায়। এমন অবস্থায় ডিম আর মুরগির বাজারে স্বস্তি রাখতে পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেট ভেঙে ডিম-মুরগির উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে শিগগিরই বাজার সহনীয় পর্যায়ে আসবে।

বিবৃতিতে ডিমের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের ভূমিকার ব্যাপারে বলা হয়, তারা প্রথমে প্রান্তিক খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করেন। পরে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় রাতে ডিম পাঠানো হয়। এরপর সকালে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ফজরের নামাজের পর দাম নির্ধারণ করে সব জায়গায় মোবাইল এসএমএস ও ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এরপর সারা দেশেই এই দাম বাস্তবায়ন করা হয়।

বিপিএ নেতা কি ভুল বলেছেন? ভোক্তাদের পকেট যাতে শূন্য করতে না পারে সিন্ডিকেটওয়ালারা এবং তাদের অবৈধ কাজ (কুকাজ) যাতে বন্ধ করা যায়, সেই পরামর্শই তিনি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার বা তাদর কৃষি অধিদফতর কি সেই পথে হাঁটবেন নাকি সিন্ডিকেটওয়ালাদের দেয়া পকেটমানি নিয়েই খুশি থাকবেন?

অতিরিক্ত ওই ২৮০ কোটি টাকা আমার পকেট থেকে যায়নি। কৃষি অধিদফতরের কর্মীদের পকেট থেকেও গেছে, এটাই আমরা ধরে নেবো। নাকি তারা বিনা পয়সায় ডিম-মুরগি পায় সিন্ডিকেটওয়ালাদের তরফ থেকে? অর্থাৎ আমি বলতে চাই, এই ক্ষতি আমাদের সকলেরই, কিন্তু তারপরেও আমরা এক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছি না। আমরা ভেঙে দিচ্ছি না দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই তিলে তিলে লুটে নেয়া ব্যবস্থা। কেন করছি না? কারণ আমরা মনে করি এর দায় ও দায়িত্ব সরকারের। হ্যা, সরকারের। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল কর্তারাই যদি সিন্ডিকেটওয়ালাদের সঙ্গে গা মিলিয়ে ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করেন, তাহলে শর্ষে থেকে ভূত কে তাড়াবে?

এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শোষণ আমাদের জনস্বাস্থ্য হাড্ডিসার করে দিচ্ছে। বিশেষ করে মহানগরের ডিম ও মুরগির মাংস লোভী মানুষদের যারা নিজেরা ক্ষতির মুখে থেকেও প্রতিবাদে মিছিলে যাবেন না। ভাবেন, লোকে বলবে কি যে এরা সামান্য ডিমের দাম কমাতে মিছিল করছে। এই লোক-লাজ ভুলে যেতে হবে আমাদের। লেংটার আবার লজ্জার কি আছে? নেমে আসুন সব লজ্জা ঝেড়ে, কেন সিন্ডিকেট করপোরেট কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের হাড়-গোড় চুরমার করে দেয়া হবে ।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দরিদ্র মানুষের হারানোর কিছু নেই। পুষ্টি পাওয়াও অধিকার আছে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আছে, ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত ভাবে। পোলট্রি ফিডের দাম কেন এতোটা বাড়ানো হলো, তার কোনো যুক্তি নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের কুযুক্তি দেয়া হয়, অমুকযুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বের সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু একবারও বলে না যে দাম কমেওছে। এই লুকোছাপা ও মিথ্যাচার আমাদের বাণিজ্যের সব থেকে খারাপ মনোভাব।

লোভের অন্য নাম হয়েছে ব্যবসা। এই লোভের দীর্ঘ জিহ্বা কেটে দিতে হবে। না হলে কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্তারা সিন্ডিকেট করপোরেট ব্যবসায়ীদের লোভের কড়াইয়ে ভাসতে থাকবেন।

আশা করি আমরা জেগে উঠবো আমাদের লজ্জার ঘুম থেকে, কঠিন বাস্তব জীবনের জমিনে পা রাখবো শক্তি ও সাহস নিয়ে। রাজনৈতিক শক্তির মিথ তো ছাত্র-জনতা ভেঙে ফ্যাসিবাদের শেকড় উৎপাটন করেছে। এখন বাজারের অস্থিরতার টুটি চেপে ধরতে হবে।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলাম লেখক।

Facebook Comments Box

Posted ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

manchitronews.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক
এ এইচ রাসেল
Contact

5095 Buford Hwy. Atlatna Ga 30340

17709121772

deshtravels7@gmail.com

error: Content is protected !!